সিলেটি ভাষা কোনো
উপভাষা নয়, বরং সম্পূর্ণ পৃথক
একটি ভাষা; প্রধানত দুটি
কারণে—
১/ সিলেটি ভাষার নিজস্ব
সম্পূর্ণ ব্যাকরণ ও লিপি
রয়েছে।
২/ বাংলা ভাষার
পাশাপাশি এ-ভাষায় এখনো
সিলেটের শিক্ষিত সমাজ
সাহিত্যকর্ম এবং বিভিন্ন
আনুষ্ঠানিক কাজকর্ম
সম্পাদন করে থাকেন।
বাংলা ভাষার মূল রীতির
সাথে সিলেটি ভাষার—
যাকে ‘ছিলটি’-ও বলা হয়—
যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে,
কেননা, সিলেটি ভাষা
পূর্বাঞ্চলীয় এবং বাংলা
ভাষার মূল রীতির ভিত্তি
নদীয়া তথা পশ্চিমাঞ্চলীয়
। বাংলাদেশের সিলেট
অঞ্চল ছাড়াও, এছাড়া
ভারতের অন্তর্ভুক্ত অসম
রাজ্যের দক্ষিণে শিলচর ও
তার পার্শ্ববর্তী এলাকার
মানুষ এবং ত্রিপুরা ও
মেঘালয়ের বহু সংখ্যক
লোকে এই ভাষায় কথা বলে
। এমনকি শুধু ভারত বা
বাংলাদেশেই সীমাবদ্ধ নয়,
ক্রমে বিশ্বের বিভিন্ন
দেশে বিস্তৃতি লাভ করেছে
। এক পরিসংখ্যানে দেখা
গেছে, সিলেট অঞ্চল এবং
ভারত ছাড়াও বিশ্বের
অন্যান্য দেশে এ-ভাষা
ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৭
লক্ষেরও বেশি। বৃহত্তর
সিলেটের বর্তমান
জনসংখ্যাই ১ কোটি ।
লন্ডনের ‘সিলেটি রিসার্চ
অ্যান্ড ট্র্যান্সলেশন
সেন্টার’-এর উদ্যোগে
পরিচালিত এক জরিপে
দেখা গেছে— সিলেট
অঞ্চলসহ সমগ্র বিশ্বে
বর্তমানে ১ কোটি ৬০ লক্ষ
মানুষের মুখের ভাষা
সিলেটি । সিলেটের প্রচুর
লোক যুক্তরাজ্যে পাড়ি
জমানোর সুবাদে সেখানেও
সাম্প্রতিককালে এ-ভাষার
পরিচিতি ছড়িয়ে পড়েছে।
শ্রেণিবিচারঃ-
-----------------------
ভাষার শ্রেণিবিচারে
সিলেটি ভাষাও ইন্দো-
ইউরোপীয় ভাষার একটি
সদস্য ভাষা । তবে এটি
ইন্দো-ইরানীয়, ইন্দো-আর্য ও
মাগধী প্রাকৃত/পূর্ব ভারতীয়
ইন্দো আর্য্য, অর্ধ মাগধী,
পূর্বী অপভ্রংশ/অপভ্রংশ
অবহট্ট, বাংলা অহমীয়া
ভাষা হয়ে বাংলা-
অসমিয়া ভাষা পরিবারের
অন্তর্ভুক্ত হয়েছে । গ্লটলগে
এই ভাষার কোড হলো—
sylh1242।[1] আর আইএসও
ইন্টারন্যাশনাল স্টান্ডার্ড
কোড— ৬৩৯-৩ : syl ।[2]
লিঙ্গুয়েজফেয়ার
অবজারভেটরি কোড— 59-
AAF-ui।
লিপিঃ-
-----------------------
ঐতিহাসিকরাও দাবি
করেন— সিলেটি একটি
প্রাচীন ভাষা এবং বাংলা
ভাষার আদি নিদর্শন
চর্যাপদের অনেকগুলো পদ
সিলেটের আঞ্চলিক
বাংলায় লিখিত ।
চর্যাপদের পদগুলো যে
বিভিন্ন ভাষা থেকে
সংগৃহিত সে-আলোচনা
ইতোমধ্যেই আমরা
রাজবংশী ভাষার
আলোচনায় সেরে এসেছি ।
আগ্রহী পাঠক সেখান থেকে
রেফারেন্স নিতে পারেন ।
যাই হোক— ভাষা গবেষক
সৈয়দ মোস্তফা কামাল ও
অধ্যাপক মুহম্মদ আসাদ্দর
আলীর মতে— জটিল সংস্কৃত-
প্রধান বাংলা বর্ণমালার
বিকল্প লিপি হিসেবে
‘সিলটী নাগরী’ লিপির
উদ্ভাবন হয়েছিলো
খ্রিষ্টীয় চতুর্দশ শতাব্দীর
মাঝামাঝি সময়ে ।
গবেষকদের ধারণা— ইসলাম
প্রচারক সুফী দরবেশ এবং
স্থানীয় অধিবাসীদের
মনের ভাব বিনিময়ের
সুবিধার জন্যে নাগরী
লিপির উদ্ভাবন হয়েছিলো ।
এ-ভাষা প্রাচীনকাল হতে
বাংলার অন্যান্য অঞ্চলের
মতো বাংলা লিপিতে
লেখা হলেও মধ্যযুগে
ইসলামের আগমনের পর
বাংলার পাশাপাশি
সিলেটি নাগরী লিপি (বা
ছিলটি নাগরী) প্রচলিত হয়।
ঐতিহ্যগতভাবে বিশ্বাস
করা হয়— বাংলালিপি
হলো ব্রাহ্মি লিপি, অর্থাৎ
হিন্দুধর্মমতে স্রষ্টা ব্রহ্মার
পক্ষ থেকে দেওয়া একটি
লিপি, তাই সিলেটের
মুসলমানগণ এই লিপি ব্যবহার
করে তাদের সাহিত্যরচনা
কিংবা লেখালেখী করতে
অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন ।
আর একারণেই ধর্মীয়
অনুভূতিকে প্রাধান্য দিয়ে
তারা আরবি আর ফার্সি
হরফকে নিজেদের হরফ বলে
ধরে নিয়ে আলাদা একটি
লিপি তৈরি করে নেয়ার
তাড়না অনুভব করেন । এরই
ধারাবাহিকতায় জন্ম হয়
নাগরী লিপির ।
তবুও লিপিটির উৎস সম্পর্কে
পরস্পর-বিরোধী বিভিন্ন
ধারণামূলক ব্যাখ্যা পাওয়া
যায়। এর কারণ হলো,
মুসলমানরা এই লিপির
উদ্ভাবক হলেও সাধারণত
তুলনামূলক নিচু জাতের
লোকেরা এই লিপির চর্চা
করতেন। ড. সুনীতিকুমার
চট্টোপাধ্যায় প্রমুখের মতে
— বিখ্যাত ধর্মীয়-পরিব্রা
জক জনাব শাহ জালাল রহ.
ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতাব্দিতে
যখন সিলেট আগমন করেন,
তিনিই এই লিপি সাথে করে
নিয়ে এসেছিলেন। নাগরী
লিপিতে রচিত বিপুল
সংখ্যক এবং সিংহভাগ
সাহিত্যকর্মই সুফিবাদ
অনুসরণ করে বলে এই ধারণা
অমূলক মনে হয় না। অন্যদিকে
ড. আহমদ হাসান দানীর মতে
— আফগান শাসনের সময়,
অর্থাৎ আফগানরা যখন
সিলেটে অবস্থান করতেন, ঐ
সময়ই তাঁদের দ্বারা এই
লিপির উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে।
এই মতকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়
আফগান মুদ্রায় উল্লেখিত
লিপি, যার সাথে সিলেটি
নাগরীর কয়েকটি বর্ণের
মিল রয়েছে। তাছাড়া
সিলেটে আফগান
অভিবাসীরাও সংখ্যায়
ছিলেন অনেক । কারও মতে—
সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতাব্দিতে
বিহার যুক্তপ্রদেশ থেকে
আগত মুসলমান সিপাহী ও
বিদেশাগত মুসলমানদের
সুবিধার জন্য সিলেটি
নাগরী লিপির সৃষ্টি হয় ।[3]
আরেকটি মত হলো—
যৌক্তিকতা কিংবা উৎস
নির্দেশ না করেই বলা হয়
কোনো এক সুচতুর মুসলমান
মুসলিম জনগণের মধ্যে
সাধারণ লেখাপড়া চালু
করার নিমিত্তে বাংলা
লিপি থেকেই এই নাগরী
লিপি তৈরি করে নেন। এটা
মূলত লৌকিক বিশ্বাস।[4]মূলত
প্রতিবেশী নেপাল ইত্যাদি
দেশ থেকে আগত বৌদ্ধ
ভিক্ষুদের মাধ্যমে এই লিপি
সিলেটে উদ্ভাবিত হয় ।[5]
ভারতের বিহার রাজ্যের
কৈথী লিপির সাথেও
সিলেটি নাগরী লিপির
সম্পর্ক রয়েছে । যদিও এর
প্রকৃত উৎপত্তি সম্পর্কে
এখনো জানা যায় নি ।
সিলেটের এই নাগরী
লিপিটি একসময় ‘সিলেটি
নাগরী’ ছাড়াও
জালালাবাদী নাগরী, ফুল
নাগরী, [6]মুসলমানী নাগরী,
মোহাম্মদী নাগরী নামেও
পরিচিত ছিলো।[7] তবে
বর্তমানে নাগরী লিপি
তেমন চোখে পড়ে না,
লেখার জন্য এখন শুধু বাংলা
বর্ণমালাই ব্যবহৃত হয়।
এই লিপি বাংলা ভাষার
মতোই ডানদিক থেকে বাম
দিকে লেখা হয় ।
বর্ণমালাঃ-
-------------------
নাগরী লিপিতে ৩২টি
অক্ষর বা বর্ণ রয়েছে।
“ং” (অনুস্বার)-কে “০”
হিসেবে ধরে এর সংখ্যা
৩৩টি; এর মধ্যে স্বরবর্ণ ৫টি,
ব্যঞ্জণবর্ণ ২৮টি। যদিও
বিভিন্ন গ্রন্থে আরো ক’টি
স্বরবর্ণের উল্লেখ পাওয়া
যায়। যেমন— শ্রী অচ্যুতচরণ
চৌধুরী তত্ত্বনিধি প্রণীত
শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত বইয়ের
পরিশিষ্টে “শ্রীহট্টের
মোসলমানী নাগরাক্ষর”
শিরোনামে উল্লেখ করা
নাগরী বর্ণমালায় স্বরবর্ণ
দেখা যায় ৬টি । সেখানে
সর্বসম্মত ৫টি বর্ণের
পাশাপাশি “ঐ” উচ্চারণের
আরেকটি চিহ্নের উল্লেখ
আছে। উল্লেখ্য যে,
বর্ণমালার স্বরবর্ণের
অক্ষরসমূহের ধারবাহিকতা
হুবহু বাংলা বর্ণমালার
ধারাবাহিকতা অনুসরণ করে
না ।
উচ্চারণ ও ধ্বনিঃ-
-------------------------------
সিলেটি ভাষার (এখানে
ভাষা মানে উপভাষাই)
চরিত্র লক্ষণ ধরা পড়ে এর
উচ্চারণে। জাতিসঙ্ঘের
সার্বজনীন
মানবাধিকারের
সার্বজনীন ঘোষণাপত্রের
ধারাগুলো সিলেটি ভাষায়
লেখা হয়েছে এভাবে— সব
মানুষ স্বাধীনভাবে জন্ম হয়
ইজ্জত আর অধিকার লইয়া .
তারার হুশ আর আকল বুদ্ধি
আছে আর তারা একজন
আরকজনর লগে রুহানি
ভাইট্টা ব্যবহার তাকত ।
স্ট্যান্ডার্ড বাংলায় যার
অর্থ দাঁড়ায়— সমস্ত মানুষ
স্বাধীনভাবে সমান
মর্যাদা এবং অধিকার
নিয়ে জন্মগ্রহণ করে বিবেক
এবং বুদ্ধি আছে তাঁদের;
সুতরাং সকলেরই একে অপরের
প্রতি ভ্রাতৃত্বসুলভ মনোভাব
নিয়ে আচরণ করা উচিত ।
ধ্বনি বিবেচনায় সিলেটি
বাষার মূলরূপটি বুঝতে আমরা
আরও কয়েকটি উদাহরণ
দিচ্ছি—
স্পৃষ্টধ্বনি : যে কুআড়ং
(বিপজ্জনক) পত (রাস্তা),
কিগুএ কইব শিলচর এগু টাউন।
আড্ডির জুড়া খআইয়া
(খসিয়ে) আইসি। ইচ্ছা করে এ
মন্ত্রী চুর ইতার গগা (নলি)
টিপিয়া ধরতাম।— অর্থাৎ,
যে বিপজ্জনক রাস্তা, কে
বলবে শিলচর একটা টাউন।
হাড়ের জোড়া খসিয়ে
এসেছি। ইচ্ছে করে চোর
মন্ত্রীর গলার নলি চেপে
ধরি।
উষ্ম ব্যাঞ্জন ধ্বনি : শাইর
করিয়া বেটাবেটি
দারাইছইন। অর্থাৎ— সারি
বেধে পুরুষ নারীরা
দাঁড়িয়েছেন।
শ্বাসাঘাত : ইগু একেবারে
আউআ (বোকা)। ঘর আউআ
(উদোম) করি আগাত (হাগতে)
গেছে। জব্বর আলিআও ই
বেটা। আর ডুলা গফ মারাত
এক নম্বর। তার মউআয়ও
(মেশো) ই কতা কইছইন।
অর্থাৎ, ও একেবারে বোকা।
ঘর উদোম রেখে হাগতে
গেছে। বড় অলসও এ বেটা।
মিথ্যা কথা বলতে ও ওস্তাদ।
তার মেশোই এ কথা
বলেছেন।
দ্বিত্ব ব্যঞ্জন ধ্বনি :
ছাততা (ছাতা) মাথাত
দিয়া তাইন আইছইন। তা ন
তো পাক্কার ঘর বাড়ি।
কিন্তু বেটা ছাত একেবারে
বাটটি।
ধ্বনি লোপ : আমার গতরো
এবো জুর আছে। অর্থাৎ,
আমার গায়ে এখনও জোর
আছে।
অপিনিহিতি : রাইক্ষসে
(রাক্ষসে) দরছে তারে।
মেউকরর (মেকুরের) মতো
চায় দেখ না। কাইল (কাল)
হারা রাইত (রাত) গাইল
(গালি) গাইল্যাইছে (গালি
দিয়েছে)। অর্থাৎ— ওকে
রাক্ষসে ধরেছে। বেড়ালের
মতো চাহনি। কাল সারা
রাত গালাগালি করেছে।
হকারী ভবন : হে তার হালির
লগে পেম করে। অর্থাৎ— সে
তার শ্যালিকার সঙ্গে প্রেম
করছে।
শিস্ ধ্বনি : গোরুয়ে ঘা খাইন
না। অর্থাৎ— গরু ঘাস খাচ্ছে
না।
সিলেটি নির্দেশক সর্বনাম
তো জগৎ বিখ্যাত । ইগু, ওগু, হগু
ছাড়াও আবার আছে
possessive case-এ এর উচ্চারণ
দাঁড়ায়— আমারগু, তুমারগু,
তারগু; প্রশ্নবোধক কিগু, কুনগু,
কয়গু।!!!!!
(আইজকে স্বরবর্ণ দিলাম!
অন্যদিন ব্যঞ্জনবর্ণ দিমু! আর
সিলেটী ভাষায় না লেখিয়
স্ট্যান্ডার্ড বাংলা
ভাষায় দিলাম বুঝার লাগি
সিলেট অর বাইরা যারা
আছোইন তারার লাগি!)
শুভ রাত্রি
ভালা থাখইন আফনে- আর
ভালা রাখইন আরেখ জনরেও!
No responses to সিলেটি ভাষা কোনো উপভাষা নয়, বরং সম্পূর্ণ পৃথক একটি ভাষা।[বিস্তারিত ভিতরে]+[Must See]
Be first Make a comment.